
প্রীতম হাসান: একঝাঁক শেষ বর্ষের ফার্মাসিষ্ট জড়ো হচ্ছে ধিরেধিরে প্রাণের ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ফাউন্টেন পেন' খ্যাত শহীদ মিনারের সামনে পার্কিং করা একটি সাদা বাস। এক এক করে আমরা ৩৭জন বাসে চড়ে বসলাম। শহরের প্রধান সড়ক এর পাশে বাসটি থামলো, রাত তখন প্রায় পৌনে ৩টায় ফিতা কেটে ট্যুর এর উদ্বোধন করলেন সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ।
মোট ৪২জনের একটা টিম আমরা নোয়াখালী থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্য রওনা হই, জেলা শহরে পৌঁছতে সকাল ৮টা।
খাগড়াছড়ির সবচেয়ে নয়নাভিরাম ও দর্শনীয় স্থান সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম বিশেষ গাড়ি 'চাঁদের গাড়ি'তে করে। উঁচু নিচু ঢাল বেয়ে ফণা তোলা সাপের মতো এগিয়ে গেছে পাহাড়ি রাস্তা, গাড়িগুলো যেন একেকটাকয়েক'শ হর্স পাওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন। কয়েকশ ফুট উঁচু পাহাড়গুলো বেয়ে সাজেক পানে যেতে যেতে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ছিটকে গেলাম, এই বুঝি আমরা কেও উড়াল দিলাম পাহাড়ের চেয়ে উঁচুতে পৌঁছাতে। সত্যিই এক মোহনীয় ভয়ঙ্কর ভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছলাম সাজেক।
বিকেল চারটায়মেঠো উঁচুনিচু পাহাড় বেয়ে আমরা পৌঁছলাম 'কংলাক পাহাড়'। খাগড়াছড়ির সবগুলো পাহাড় এক সাথে দেখতে কংলাকের জুড়ি মেলা ভার, যেন এক আকাশচুম্বী গগণবিদারীআত্মচিৎকারে সে ঘোষণা করছে, আমি সেরা, আমিই উপরে। সাজেকে মেঘ ধরার স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেলো।
পরদিন সকাল ৫টা ৩০মিনিট; আকিব এর নামাজের ডাক যাক বাবা ক্লান্ত দিনের পর এটুকু সান্তনা যে সূর্যোদয় দেখা যাবে, দৌড়ে গেলাম সাজেক এর কলিজার উপর দাঁড়ানো সেই 'হেলিপেড' এ। নাহ্! সূর্যিমামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে, আর হলনা, ৫মিনিট আশাহত হয়ে বসে থাকার পর মাথার উপর মিষ্টিরোদছুঁয়ে যেতেই মনটা আনন্দে নেচেউঠলো, আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাঠচুকিয়ে আমরা রওনা হলাম 'আলুটিলা গুহা' জয়ের উদ্দেশ্যে, পলাশ কর্মকার স্যারের ভাষ্যমতে এটাই খাগড়াছড়ির সবচেয়ে সুন্দর ও এডভেন্চারাস জায়গা। ভ্রমনাবস্থায় স্যারের কথাগুলো গো-গ্রাসে গিললাম আর অপেক্ষায় রইলাম সেই গুহার, যেখানে দেখা হবে ভয়ঙ্কর কোনো ডায়নোসর বা বড় কোনো সিংহের সাথে। মশাল হাতে প্রায় ২০০সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন আলুটিলারভিতরটায় ঢুকলাম, ভিতরটা 'ডিবডিব', 'ডিবডিব' করছিলো; ভয়ে নাহ! উত্তেজনায়। ১০মিনিটের খানিকটা কম অথবা বেশী লাগলো এপাশ থেকে ওপাশ পার হতে। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে কে কে ভয় পাচ্ছিলো জানিনা তবে, চিৎকার এর আওয়াজ পাচ্ছিলাম ক্ষণেক্ষণে, পিচ্ছিল পথ আর নীরব নীথর গুহা সে এক সত্যিকার এডভেন্চার, সে এক চোখ বন্ধ করা উফফফ! অনুভূতি।
২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, মাইকে শুনছিলাম "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে" হা!হা!হা! বাঙ্গালী জাতীয় দিবস চিনে তবে ভাষা দিবস চিনেনা
সে যাইহোক ;বান্দরবানের 'হোটেল হিল কুইন' সৌন্দর্য্যে কুইন নাইবা হলো, তবে পরিবেশে কিং। যাবো নীলগিরি, চাঁদের গাড়ি গুলো যেন একেকটারিমান্ডাগার, পর্বতারোহনের শেষ অবধি আমাদের সবারইবাহুযুগলেরমাংশপেশীতে রীতিমতো স্টিমরোলারেরর ডলা চলল।
এক পশলা বৃষ্টির মতো আমাদের সব কষ্টগুলো ধুঁয়েমুছে সাফ করে দিলো সাথে একগুচ্ছ কদম এর খুশি; হুমম চোখ ধাঁধানোনীলগিরি, যতদূর চোখ যায় সাদা মেঘের আস্তরণ। বলাবাহূল্য, আসার পথে মেঘের খুবই কিয়ংদশ অংশ আমাদের গায়ে পড়েছিলো। সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি অপরুপনীলগিরিররুপসূধা পানে সবাই ব্যস্ত, কেও ক্লিক ক্লিক আওয়াজ তুলছে 'ডিএসএলআর' এর কালো ফ্রেমে, সবার মতো করে আমি দুহাতদূপাশেছুঁড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, আর দূরের আকাশ পানে চেয়ে দেখছিলাম, পাহাড়ের বিদীর্ণ সবুজের কোল বেয়ে সাদা মেঘের মিতালী।
১৫মিনিটের ব্রেকে 'চিম্বুক পাহাড়' নামে একটা উৎসাহহীন জায়গায় গিয়ে সত্যিই একটা হিমশীতল বাতাস বয়ে গেলো, দেহে লাগা এ ঠান্ডা বাতাস দেহ থেকে মন, মন থেকে মস্তিষ্ক হয়ে সারা শরীরে ছেঁয়ে গেলো। প্রকৃতির এ অবিসংবাদিতসৌন্দর্য্য মহান রাব্বুলআ'লামীনেরসমহীমা প্রকাশ করে। মিসবাহ্বলছিলো, 'চিম্বুকেরসৌন্দর্য্যতোনীলগিরি কেও হারিয়ে দিলো '। কখন যে ৩০মিনিট পার টেরই পেলামনাহ্, পাওয়ার কথাওনাহ্, চত্তরে সাজানো এ চিম্বুকের কোলে মেঘের আনাগোণা তো এত কাছে যে ছুঁয়ে দেখার মতো সত্যিই অবিশ্বাস্য।
মাঝে 'বুদ্ধ স্বর্ণমন্দির ' এ গিয়ে সোনালী মোড়কের দেবতা দেখা ছাড়া বিশেষ কোনো স্বাদ ই পেলামনাহ আমরা কেওই।
আজকের মতো সফরটা এখানেই শেষ, যারা চিম্বুক সফরটা মিস করলো তাদের কে চললো চরম আকারের খ্যাঁপানো।
২৭তারিখের কক্সবাজার সফরটা ব্যাপক না হলেও সবুজ পাহাড় পেরিয়ে পরিশ্রান্ত দেহ মন জুড়াতে সাগরের ঢেউগুলো যথেষ্ট বৈ! কি!
পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম এ সমুদ্রসৈকত এ সূর্যস্নান দেখা আর রাতের আঁধারে গিটারের তারে পারভেজেরগলাছেড়ে গানে উন্মাতালদেহমন।
টেকনাফ হয়ে 'কেয়ারী সিন্দবাদ' যখন নাফ নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন বিখ্যাত শৃগালগুলোর উড়ন্ত ছবি আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এ মোহনীয় সুরের আবির্ভাবের গোড়াপত্তন করে।
দূপুর ১২টায় গিয়েও সেন্টমার্টিন এ চলে বিকাল অবধি "প্রচন্ডট্যুর" ;খেলাধুলা ও সমুদ্রস্নান ।
সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে উপভোগ্য ব্যাপার হল এর সামুদ্রিক প্রবাল ও নীল পানি । নারিকেল জিন্জিরা নামে পরিচিত এ কোরাল দ্বীপ বিখ্যাত এর তাজা মাছ ও নায়নাভিরাম নীল সৌন্দর্য্যের কল্যাণে।
বৃহস্পতিবার বিকালে সবাই রওনা দিলাম সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শাখা দ্বীপ "ছেঁড়া দ্বীপ"। ভয়ঙ্কর সুন্দর এ দ্বীপে যেতে ট্রলারে করে রওনা হলাম বিকাল ৩টায় আর ফিরলামগগণ এর পাদটীকা ছুঁয়ে সূর্য যখন সমুদ্রে সম্পূর্ণবিলীন হয়ে যায় তখন। কিন্তু এর মাঝে আঁকা হয়ে গেছে কিছু স্মৃতি, কিছু সোনালী অতীত, কিছু হদয়স্পর্শীকর্মযোগ্যে।
সামুদ্রিক প্রবালে একাকার এ ছেঁড়া দ্বীপ মিয়ানমারসীমান্তের ৬কি.মি. পাশ্ববর্তী ও সেন্টমার্টিনের মূল ভুখন্ডের ৮কি.মি. দূরবর্তী।
সেলফি আর ছবির যেনো হিড়িক পড়ে গেলো, চোখ ছুঁটে যায় ওই দূর সমুদ্রপানে, যেখানে সীমানা দেখা যাচ্ছেনা, তবু সৃষ্টির সেরা আশ্চর্য এই সমুদ্র বুকে জেগে ওঠা 'ছেড়া দ্বীপে' কতোপ্রানোচ্ছলতা, চক্ষুচড়ক গাছ সুন্দর দৃশ্য এ এক আকর্ষন, এ এক লোভনীয় ভ্রমণ, এ এক সৃস্টিশীলআল্পনারমতো বাস্তব দৃশ্য।
৭দিনের এ ট্যুর যেন পড়ন্ত বিকেলে একফালি মেঘ ও তুষার ঝড়।
ফেরার পথে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের মাঝে ছিলোহারানোর নীল ছাপ, মনের অজান্তে এসব স্মৃতি হয়তোবা ১০০ছুঁইছু্ই বয়সে নাতিনাতনীদের কাছে ফোকলা দাতে বলা স্মৃতিকথা হয়ে বেঁচে থাকবে যুগ থেকে যুগান্তর। শিক্ষার্থী সাফায়েত পুলক বলেন, "০৭ দিনের ট্যুরের স্মৃতি রোমান্থন করে শত সহস্রকাল পার করে দেয়া যাবে।"
উল্লেখ্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর ফার্মেসী ৯ম ব্যাচের "ফাইনালট্যুর" ছিলো এটি। ট্যুর এ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. মো.আনোয়ারুলবাশার, সহকারী অধ্যাপক ড.হাসানুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক ড. আরিফুর রহমান।
ট্যাগ: Banglanewspaper ফাইনাল ট্যুর অমলিন স্মৃতি