
এম মতিউর রহমান মামুন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন 'সকল রকম ক্ষমতার কাছেই আমরা পরাভূত হয়ে আছি - প্রকৃতি যখন উপদ্রপ করে তাও সয়ে থাকি, রাজা যখন উপদ্রপ করে তাও সয়ে থাকি' কথাগুলো এই কারনে বললাম ক'দিন আগে একটি অনলাইনে দেখলাম ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে ভিজিএফের চাল কম দেওয়ার প্রতিবাদে শফিকুল নামের এক ভ্যান চালক চেয়ারম্যান সাহেব নিগৃহীত করে তাঁর চৌকিদার দফাদার দিয়ে ঠেঙিয়ে বিদায় করেছেন ঐ ভ্যান চালককে। নিরুপায় শফিকুল কালিগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট অভিয়োগ জানিয়েছেন। শুধু তাই নয় বেশ কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে কিছু চেয়ারম্যান, মেম্বারদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের খবর প্রাকাশিত হয়েছে যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।
প্রকল্পের অনিয়ম, অবৈধ পন্থায় বিত্তবৈভব অর্জন, মাদক বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের খুনখারাবি, ব্যাপক চাঁদাবাজি; লুটপাট, বিপুল পরিমাণ ঘুষ-বাণিজ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো ও রাস্তাঘাট নির্মানের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা, কাবিখা, টাবিখা, টিআর, বিভিন্ন কর্মসূচির নামে লুটপাট, কিছু কিছু চেয়ারম্যান মেম্বারদের বিরুদ্ধে একম আরও কিছু অভিযোগ।
যে কোন মূল্য একবার চেয়ারম্যান হতে পারলেই অবৈধ্য বিত্তসম্পদের মালিক হওয়ার উচ্চ স্বপ্ন তাদের। রীতিমতো এই মহৎ পেশা এখন লোভের দাসে পরিনত হয়েছে, এমন সংবাদ উঠে এসেছে গণমাধ্যমেে। খবরটা আমাদের জন্য দুঃখের এবং হতাশার তো বটেই, কেননা জনগণের সেবা পাওয়ার কথা স্থানিয় সরকারের ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদে গিয়ে। সেখানে চেয়ারম্যান মেম্বারগণ যদি জনগণের সম্পদ লুণ্ঠণকারী হন তাহলে তাহলে জনগণ যাবে কোথায়? সরকারের পক্ষে ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়েরর সকল নাগরিকের আশ্রয়স্থল বিবেচিত হয়, বিধায় সেখানে পরিছন্নতার প্রয়োজন আছে। সবার ধারনা প্রকৃত সেবা জনসাধারণ কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে সরকার প্রথম বারের মতো দলীয় প্রতিকে স্থানিয় সরকার নির্বাচন করেছে। উদ্দেশ্য সরকারের গৃহীত সকল উন্নয়ন যথাযথ পালন করে চেয়ারম্যান মেম্বারগণ সাধারণ জনগনের মাঝে সরকারের সকল উন্নয়ন পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করবেন, তাতে সরকারের বহুমূখি উন্নয়ন জনগণের দোরগোড়ায় খুব সহজে পৌঁছে যাবে। কিন্তু সরকারের সেই মহৎ উদ্দেশ্য কতটা ব্যাস্তবায়ন হচ্ছে সেদিকে একবার নজর রাখা দরকার। গত ৮ জুলাই জাতীয় একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল 'খুন মাদক বাণিজ্য চাঁদাবাজিতে তৃণমূল জনপ্রতিনিধিরা' গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে 'তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা জড়িয়ে পড়ছেন নানা অনিয়ম ও গুরুতর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে সেবা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত অনেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বার বর্তমানে নিজ নিজ এলাকায় হয়ে উঠেছেন মূর্তিমান আতঙ্ক। তৃণমূলের এসব জনপ্রতিনিধি খুন, অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্য, বালুদস্যুতাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেক জনপ্রতিনিধি গ্রাম্য সালিসের নামে নিজ নিজ এলাকায় কায়েম করেছেন ঘুষের রাজত্ব। গত এক বছরে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগে শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে বহিষ্কার করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে জানা যায়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এসব বেপরোয়া চেয়ারম্যান ও মেম্বারের লাগাম টেনে ধরতে হবে'। গত ২৯ তারিখ বুধবার অপর এক জাতীয় দৈনিকে বলা হয়ছে ' পুকুর থেকে বিপুল পরিমান ভিজিএফের চাল উদ্ধার' তাতে বলা হয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের ৩টি পুকুর থেকে প্রায় ৩ হাজার কেজি ভিজিএফের পোঁচা চাল উদ্ধার করা হয়েছে।
এমন একটি প্রতিবেদন পড়ার পর প্রশ্ন আসতে পারে এরা কেমন জনপ্রতিনিধি? আর যদি জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকেন তাহলে এমন কাজ করতে পারেন কি করে? চেয়ারম্যানগণ দলীয়, তাঁরা নিজ দলের ব্যানারে নির্বাচিত, আ'লীগ অথবা বিএনপি যাই হোক। সক্রিয় দলের নেতাকর্মি ছাড়া কেউ নমিনেশন পাননি বলেই মনে হয়। আর যদি অন্য উপায়ে কেউ নমিনেশন নিয়ে থাকেন তা ভিন্ন কথা। নমিনেশনের পূর্বে সেই ব্যাক্তি নিয়ে যাচাই বাছাই করে নিলে এমন অভিযোগ নাও উঠতে পারতো। বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে এসব সামাজিক ব্যাধির লম্বা খতিয়ান , বিশেষ করে দুর্নীতি,বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম, চরম অবৈধ পন্থায় বিত্তবৈভব অর্জন, মাদক বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের খুনখারাবি, ব্যাপক চাঁদাবাজি; লুটপাট, বিপুল পরিমাণ ঘুষ-বাণিজ্য সমাজকে এতটা ব্যাপকভাবে দূষিত করে চলেছে যে, এর দুষ্ট পরিণাম রাষ্ট্রের গায়ে কালো দাগ এঁকে চলেছে। আর যে, দল থেকে নির্বাচিত হযেছেন সে দলের জন্য ক্ষতির কারণ তো বটেই। তাই সৎ, যোগ্য, ত্যাগী, মেধাবী, যাঁরা প্রকৃত দেশ ও জনগণের কল্যানে রাজনিতীতে নাম লিখিয়েছেন সেই নেতাদের উচিত হবে নিজ নিজ এলাকার অভিযুক্ত চেয়ারম্যানদের লাগাম টেনে ধরা,তা না হলে সামনে নির্বাচনে এরা দলের মহা বিপদের কারণ হলেও হতে পারে। সেখানেও অভিযোগ আছে, স্থানিয় নেতাকর্মিদের অভিযোগ তাঁদের না জানিয়ে কোন পরামর্শ না করেই নামে বেনামে প্রকল্প দাখিল করেন, বিধায় তাঁদের অজান্তে চেয়ারম্যান মেম্বারগণ দূর্নীতি করেন। ভাবনার বিষয় রাষ্ট্রের গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ, সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ যদি ব্যাদিগ্রস্থ হয়, দূর্নীতিগ্রস্থ হয় তাহলে জনগণ সেবা পাবে কি করে? সেবা নিতে এসে যদি টাকা গুনতে হয়, দুস্থমাতা, ভিজিএফ, ভিজিডি নিতে যদি তাঁদের খুসি করতে হয় তাহলে দারিদ্র বিমোচন হবে কি করে? আর জনগণই যাবে কোথায়? গ্রামীণ প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা যদি চেয়ানম্যান, মেম্বারের পকেটে যায় তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে কি করে? এক্ষেত্রে উপজেলা প্রসাশন যদি তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে কেবল চেযারম্যানদের দূর্নীতি অনেকটা রোধ করা সম্ভব। কেননা যে প্রকল্পই বলি উপজেলা নির্বাহী কর্মতর্তার স্বাক্ষর ছাড়া বিল উত্তলন সম্ভব নয়, বিধায় কিছুটা দায়তো থেকেই যায়। গত ২৩ জুলাই সহযোগি এক পত্রিকায় বিসিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, ভাষা সংগ্রামী ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক তাঁর উপ সম্পাদকীয়তে লিখেছেন 'অভিযোগের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। খুব সংক্ষেপে বলতে হয়েছে, এসব 'জনপ্রতিনিধি খুন, অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্য, বালুদস্যুতাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন, ... কায়েম করেছেন ঘুষের রাজত্ব। নিজ নিজ এলাকায় এরা মূর্তিমান আতঙ্ক। তাঁর প্রতিবেদনে আরও বলেছেন' বৃহত্তর কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা জেলার একাধিক অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ও কোনো কোনো এলাকার তৃণমূল প্রশাসন। সঙ্গত কারণে কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয় প্রশ্ন তুলেছে : 'এরা কি জনপ্রতিনিধি?' তাদের যুক্তিনিষ্ঠ দাবি : 'এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন।' কঠোর ব্যাবস্ত নেওয়া অতান্ত জরুরী কেননা স্থানিয় সরকারের নিন্মস্তর থেকে যদি দূর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব না হয় তাহলে এক সময় মহামারী রুপ নিতে পারে আর তার বলি হবে সাধারণ জনগণ। সে ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মি, স্থানিয় সংসদ সদস্য ও দূর্নীতিদমন কমিশনের সহযোগিতার প্রয়োজন। তা না হলে যে সমস্ত চেয়ারম্যান মেম্বারদের দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে তাদের প্রতিহত কঠিন হবে। তাদের দূর্নীতির শিকল টানতে না পারলে সরকার গ্রামের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের কল্যানে গৃহীত যুগান্তকারী সকল পদক্ষেপ ভেস্তে যেতে পারে। তাতে দুস্থ অসহায় মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত সিংহভাগ অর্থ ঐ সমস্ত চেয়ারম্যানদের পকেটেই থাকবে। ইতিপূর্বে যে সমস্ত চেয়ারম্যান মেম্বারগণ বহিস্কার হয়েছেন তারা চাইবেন আদালতের দ্বারস্থ হয়ে আবার তাদের চেয়ারে ফিরে আসতে। আর যদি পারেন তাহলে তারা পূর্বের ন্যায় বীরদর্পে আবার লুটপায় শুরু করবে, তাই এখনি এদের লাগাম টেনে ধরা দরকার। সেই সঙ্গে গ্রামীণ আবকাঠামো নির্মান, রাস্তাঘাত মেরামত, কাবিখা, টাবিখা, চল্লিশ দিনের কর্মসূচী, বিভিন্ন ভাতাদি সুষ্ঠ বণ্ঠণ হচ্ছে কি না কর্তিপক্ষের তা তদারকি প্রোয়োজন। পরিতাপের বিষয় দিন দিন এই সামাজিক ব্যাধি বেড়েই চলেছে, এভাবেই চলতে থাকলে একদিন জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞাও পাল্টে যেতে পারে। কেননা সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত সৎ, যোগ্যদের স্থান নেই না ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে, প্রখ্যান্তরে অবৈধ অর্থের মালিক, সন্ত্রাসী বা পেশি শক্তিতে বলীয়ান চরিত্রহীন ব্যক্তিরাই বেশি করে দলীয় টিকিট ভাগিয়ে চেয়ারম্যান হচ্ছেন। মান-সম্মানের ব্যক্তি মর্যাদা রক্ষার্থে যোগ্যরা তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে অনিচ্ছাই প্রকাশ করেন, কেননা কেডারবাজি, খুন যখমের ভয় তো থেকেই যায়। সংগত কারণে আগামী নির্বাচনে সৎ যোগ্য, পরিশ্রমি, মেধাবী, ত্যাগী, বিণয়ী নেতাকর্মি যেন দলীয় নমিনেশ পান সেই ব্যাবস্থা করা অতিজরুরী। অন্যথায় পিছিয়ে পড়া বিপুল জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তাও তিমিরেই রয়ে যেতে পারে, তাতে বাংলাদেশ কে উন্নত রাষ্ট্র গঠণের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তাতেও প্রধান অন্তরায় হতে পারে। যাহোক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন যেহেতু রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাই চেয়ারম্যানের সন্ত্রাস-দুর্নীতির লুটপাটের দায় অনেকাংশে রাজনৈতিক দলের কাঁধে চলে যায়। সেই দল সম্পর্কে জনমনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং পরর্বতী নির্বাচনগুলোতে সেই দল ভোটের মাঠে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়। তাই দ্রত দূর্নীতিবাজ চেয়ারম্যানের, মেম্বারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যে, গ্রামোউন্নয় ও পল্লীপূর্ণগঠনের জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা যথাযখ বাস্তবায়ন হতে পারে।
লেখক: রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ নিউজ আওয়ার-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
ট্যাগ: banglanewspaper চেয়ানম্যান